মানুষই মুছে দেয় ইতিহাসের কলঙ্ক। সম্প্রীতিতে দ্রব হয় ভিন্ন ধর্মের সংস্কার, মিলিয়ে যায় হিন্দু-মুসলিম জাতপাতের বিভেদরেখা। সেই নজির দেখা গেল মহরমের দিন কাশ্মীরে। এদিন অমরনাথ যাত্রীদের ফলের রস, জল, কেশর চা ইত্যাদি বিতরণ করলেন কাশ্মীরি মুসলিমরা। কাশ্মীর উপত্যকায় একই রাজপথে পাশাপাশি পথ পেরলো মহরমের মিছিল আর তীর্থযাত্রীদের গাড়ি -ডুলি। সেই মিছিল থেকে পরস্পরকে প্রীতি জানালেন দুই ধর্মের মানুষ। কাশ্মীরের রাজ্যপাল মনোজ সিনহা একই দিনে দুই ধর্মের মানুষকে সম্ভাষণ জানালেন। আজানের আল্লা হো আকবর আর অমরনাথ যাত্রীদের হর হর মহাদেব ধ্বনি অনুরণনে মিশে গেল। মহরমের দিনে হিন্দু মুসলিমের এই সম্প্রীতির ছবিটা মুছে দিল প্রায় আড়াই মাস আগের পহেলগাঁওয়ের কালো দিনের স্মৃতি।
গত ২২শে এপ্রিল, শ্রীনগর এর পহেলগাঁওতে বৈসরন ভ্যালিতে ঘটে গিয়েছিল সন্ত্রাসের এক নারকীয় ঘটনা। সেদিন পর্যটকদের ২৬ জনকে হত্যা করা হয়েছিল তাঁদের ধর্মের পরিচয় জেনে। সেই ২৬ জনের মধ্যে অবশ্য এক পনিওয়ালা কাশ্মীরি মুসলিমও ছিলেন। যিনি সেদিন সন্ত্রাসবাদীদের বাধা দিতে গিয়েছিলেন। তবু সেদিন ধর্মের পরিচয় জেনে হিন্দুদের হত্যার ঘটনায় কাশ্মীরের মাটিতে লেগেছিল কলঙ্কের দাগ। সেই দাগ ধুয়ে গেল রবিবার মহরমের দিনে, যেদিন সেই কাশ্মীর থেকেই অমরনাথের উদ্দেশ্যে রওনা হওয়া যাত্রীদের মাথায় গোলাপের পাপড়ি, কাশ্মীরের সুগন্ধি ছুঁড়ে , জল-সরবত-ব্রান্ডেড ফলের রস-কাওয়া হাতে তুলে দিয়ে শুভকামনা জানালেন ইসলাম ধর্মাবলম্বীরা। পহেলগাঁওতে সন্ত্রাসবাদীদের জ্বালানো আগুন এদিন বুঝি নিভে গেল সম্প্রীতির বারিতে।
একদিন এই কাশ্মীরেরই এক মুসলিম মেষপালক বুটা মালিক আবিষ্কার করেছিলেন অমরনাথের শিবলিঙ্গের গুহা। প্রতিবছর দলে দলে মানুষ কাশ্মীরের মাটি ছুঁয়ে এখানকারই প্রশাসনের নানান ধরনের সহযোগিতা পেয়ে যাত্রা করেন অমরনাথের উদ্দেশে।
এক প্রত্যক্ষদর্শী গোলাম আহমেদ জানালেন এটাই আমাদের কাশ্মীর। যেখান থেকে অমরনাথের উদ্দেশ্যে হিন্দুরা যাত্রা করেন তাদের ধর্মের বিশ্বাসে, আর আমরা কাশ্মীরবাসীরা তাঁদের নিশ্চিন্ত করি নিরাপত্তার আশ্বাসে। আমাদেরই বয়ে নিয়ে চলা ডুলিতে চেপে বা ঘোড়ায় চড়ে অমরনাথ যাত্রীরা পৌঁছে যান তাঁদের দেবতার আলয়ে।
এবছর গত বুধবার ২ জুলাই থেকে শুরু হয়েছে অমরনাথ যাত্রা। রবিবার ৭২০৮ জন তীর্থযাত্রী দক্ষিণ কাশ্মীরের পহেলগাঁও , স্থানীয় ভাষায় নুনওয়ান থেকে মহররমের দিনে যাত্রা শুরু করলেন অমরনাথের দিকে। যে তীর্থযাত্রীদের মধ্যে দেড় হাজারেরও মতো মহিলা এবং তিরিশ জন শিশুও রয়েছে। বুধবার অমরনাথ যাত্রা শুরুর পর থেকে এটাই ছিল তীর্থযাত্রীদের সবচেয়ে দীর্ঘ এবং পঞ্চম ব্যাচ। রবিবার দুপুরে জম্মুর ভগবতীনগর বেস ক্যাম্প থেকে ২ টি ভিন্ন কনভয়কে সামনে রেখে, সেনা বাহিনীর নিরাপত্তা বেষ্টনীর মধ্যে দিয়ে তীর্থযাত্রীরা রওনা হলেন কাশ্মীরের অনন্তনাগের অভিমুখে। সেই মুহূর্তে রাজ্যপাল জেনারেল মনোজ সিনহা অমরনাথ যাত্রীদের অভিবাদন জানালেন পতাকা নাড়িয়ে। একটু পরেই কাশ্মীরের ভিন্ন প্রান্তে দেখা গেল ভিন্ন দৃশ্য। এদিনই কাশ্মীরের মাটিতে আশুরার উদযাপনে মহরমের প্রথাগত মিছিলে অংশ নিলেন সেই মনোজ সিনহাই। ইমান হসেনের প্রতীকী ঘোড়া জুলজানাহতে চাদর চড়ালেন। এভাবেই এদিন হিন্দু মুসলিম দুই ধর্মের আচার পালিত হল পথের প্রান্তে, সব ধর্ম মতের পথ এসে মিলে গেল উপত্যকার মাটিতে।